বাঙালি জাতির উদ্ভব ও বিকাশ
“সর্বপ্রথম কোন সময়ে বাংলা দেশে মনুষ্য বসতি আরম্ভ হয় তাহা জানিবার উপায় নাই।‘’
( রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলা দেশের ইতিহাস প্রথম খন্ড)
বর্তমানের বাংলা আগে ‘ পুন্ড্র-গৌড়-সুহ্ম-রাঢ়া-তাম্রলিপ্ত-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল’ইত্যাদি বিভিন্ন জনপদ ও রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। (বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব–নীহাররঞ্জন রায়)
আর্যরা বাংলাদেশের প্রাচীনতম অধিবাসী ছিলেন না। আর্য সভ্যতার সময় আর্যরা এই বঙ্গদেশে প্রবেশ করতে চাইতেন না। তাদের কাছে এই ভূমি চন্ডাল দের দেশ, এখানকার অধিবাসীরা অসভ্য বর্বর। তবে মহাভারতের সময়ে এই বঙ্গভূমিতে আর্যদের প্রবেশ দেখা যায়। এই বিবরণ থেকে বোঝা যায় বঙ্গদেশে আর্যদের আগেও মনুষ্য জাতির বসবাস ছিল। জাতি হিসেবে ‘বঙ্গ’শব্দের প্রাচীনতম ব্যবহার রয়েছে ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে।
বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি নামক এক মিশ্র জাতির উদ্ভব হয়েছে তার ঘটনা পরম্পরা ইতিহাসে অতল গহবরে কুক্ষিগত ; তার যথার্থ স্বরূপ খুঁজে বার করা সহজ ব্যাপার নয়। নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা বাঙালি সমাজের মানুষের মাথার খুলি মেপে, শরীরের গড়নের জরিপ করে বাঙালির জাতির উদ্ভব জানার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক দের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। রিজলে সাহেব বাঙালি জাতি সম্বন্ধে যা বলেছেন রমাপ্রসাদ চন্দ তা স্বীকার করেননি। রমাপ্রসাদ চন্দ যে তত্ত্ব প্রমাণ করতে গেছেন হারান চন্দ্র চাকলাদার তা মানতে পারেননি এবং পূর্বতন বিশেষজ্ঞদের মতের প্রতিবাদ করে বিরজাশংকর গুহ ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন।
পূর্ব ভারতের জনতত্ত্ব প্রধানত দুটি শাখায় বিভক্ত——প্রাগাআর্য নরগোষ্ঠী ও আর্য নরগোষ্ঠী। প্রাগার্য নরগোষ্ঠী বাঙালি জীবনের মেরুদন্ড।হাজার দুই বছর আগে বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বিস্তার লাভ করতে শুরু করে ; বৈবাহিক সম্বন্ধের দ্বারা মিশ্রণ শুরু হয়। নৃবিজ্ঞানীরা ও ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন বাংলার আর্যেতর জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক , দ্রাবিড় এবং ভোটচীনীয়। নেগ্রিটো জাতীয় মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগে আফ্রিকা থেকে এসেছেন। আসামের নাগাদের মধ্য এদের অস্তিত্বের সামান্য কিছু চিহ্ন দেখা যায়। বাঙালি জাতির প্রধান অংশটি অস্ট্রিক গোষ্ঠীর । ইন্দোচীন থেকে অস্ট্রো-এশীয় ভাষীরা মোটামুটি পাঁচ,ছয় হাজার বছর আগে আসেন। কোল, ভীল, সাঁওতাল, মুন্ডা মূলত অস্ট্রিক জাতি। দ্রাবিড় জাতি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে এই দেশে প্রবেশ করে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। দ্রাবিড় জাতি সভ্যতায় অনেক উন্নত ছিল। ফলে অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের অস্ট্রিক গোষ্ঠীকে গ্ৰাস করে ফেলা তাদের পক্ষে অসাধ্য ছিল না। বাংলাদেশ এই জাতির মিশ্রন ঘটেছিল।
বাঙালি জাতি আর্যামির বড়াই করলেও উচ্চনিম্ন বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির শিরা ধমনীতে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় রক্ত বহমান। ভোটচীনীয় জাতির মূল শাখা ইয়াংসিকিয়াং নদীর উৎস এর কাছে বসবাস করত। মনে হয় তারা খ্রি: প্রথম সহস্রাব্দে হিমালয় পার হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ করে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অর্থাৎ মৌর্য যুগের আর্যীকরণ এদের ঘটতে থাকে।মৌর্য বিজয় থেকে গুপ্তাধিকার পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব 300 থেকে 500 অব্দ পর্যন্ত এই কয়েকশো বছর ধরে বাংলায় আর্যীকরণ-এর ধারা বহমান ছিল। অঙ্গ, মগধে প্রথম আরম্ভ, তারপর দেখা যায় রাঢ় এবং পুন্ড্রে। অনেকেই মনে করেন ভোটচীনীও গোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে রাজবংশী, কোচ এরমধ্যে। বাঙালি জাতি তত্ত্বের বিষয়টি অনেকটাই জটিল। বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই বিষয়টি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন যে—-“বাঙালি জাতিতত্ত্বের দিক থেকে যাই হোক যতদিন বাংলাভাষা সৃষ্টি হয়নি, ততদিন বাঙালি জাতি গঠিত হয়নি। ভাষা না হলে Nation বা জাতি হয় না।‘’এই মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতেই পারে যে চর্যাপদ এর সময় থেকেই বাঙালি জাতি নিজের জাতি সম্পর্কে এবং ভাষা সম্পর্কে সচেতন হয়। এবং একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা বাঙ্গালী জাতিকে এক শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে নিজেদেরকে ভাবতে পারি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: তথ্যগতভাবে কোথাও ত্রুটি থাকলে মার্জনীয়, সুচিন্তিত মতামত জানাবেন।