ছায়াসূর্য
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন
ও একটা দুর্দান্ত পুরুষ হৃদয়।
ও একটা আশ্চর্য পুরুষ ইচ্ছে।
অথচ কৈশোরের অনাবিল মাধুর্য ওর চেহারাকে সঘন করে রেখেছে। ও দুরন্ত বেয়াড়া উল্লাসে মাতোয়ারা যুবতি বিধবার বিলাসী স্বপ্নের মত। প্রচণ্ডতা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অবাক দৃষ্টির প্রতিফলন ওর সব কাজে। তেরো বছরের অপুষ্ট দেহটা হৃদয়ের এ আবেগকে ধারণ করতে পারে না। যেজন্য চরবিলাপীর লোকেরা ওকে বলে ডেপো। আসলে ও তা নয়। ওর হৃদয়ে অদ্ভুত পুরুষ ইচ্ছে শাপলার গহীন বুকে কেলি রত পানকৌড়ির মত মুখ গুজে পড়ে আছে। ওর প্রারব্ধ বাসনা কোন কিছুতেই বিমূর্ত নয়।
বৈকালীর পড়ন্ত রোদ যখন চরবিলাপীর কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বঙ্গোপসাগরে আছড়ে পড়ে তখন ও পাড় ঘেঁষে হাঁটতে থাকে। সাগরের সীমাহীনতা ওর দু চোখে কোনো এক প্রত্যয়ের ইশারা ঘনিয়ে তলে। বিলীয়মান রোদের কণা আর সাগরের কৌতুহলী শব্দ ওকে উষ্ণ করে। তারপর ঝুপ করে রোদ বুড়ি গাঙ্গের বুকে ডুব দিলে ও চঞ্চল হয়ে ওঠে। আর তক্ষুণি মার কথা মনে পড়ে। মনে পড় মা লাল মোরগের ঝুটি টা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আলের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের তলে নরম মাটি সুড়সুড়ি দিচ্ছে; মা সরে সরে দাঁড়াচ্ছে। এটা মার একটা অভ্যেস। ও জানে সন্ধ্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে না ফিরলে মা কেবল-ই ছটফট করে। আর তখনই ওর হৃদয়ে পুলক জাগে। পুলকিত হয় ওর সমগ্র চেতনা। মা শুধু ওর জন্য—শুধু ওর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর কথা স্মরণ করেই মা অন্ধকার ঘরে কুপি দেয়। ওর লাল মোরগটা বুকে নিয়ে পাখায় হাত বুলোয়। উপলব্ধির এবং আনন্দিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ও অদ্ভুত বিষন্নতায় চেঁচিয়ে ওঠে। মার জন্য বুকটা কেমন যেন করে।
কেননা বাবা মারা যাবার পর থেকেই মার বুকটা পোড়ামাটির মত এখন কাল। ও দেখেছে জায়নামাজে উবুড় হয়ে মা বাবার জন্য কাঁদে। উঠোনের পূব পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জামরুলের ছায়া যেখানে আছড়ে পড়ে প্রসক্তির নিবিড় প্রলেপে কানপেতে মা রোজই সে দিকে তাকিয়ে থাকে। অথবা সম্ভোগের নরম রেনু গায়ে মেঘে ঘাসফুলের প্রসূন হৃদয় যেমন উন্মনা হয় , মার আদিম ইচ্ছে তখন বাবাকেই খোঁজে।